সাহিত্যে রক্তঝরা মার্চ: প্রেরণা উদ্যম ও শক্তির বাতিঘর- মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

প্রকাশিত: ৮:২৯ অপরাহ্ণ, মার্চ ৮, ২০২৪ | আপডেট: ৮:৩০:অপরাহ্ণ, মার্চ ৮, ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে এতটাই গভীরভাবে মিশে গেছে যে, বাংলাদেশে যারাই লেখালেখি করছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধকে চেতনে কিংবা অবচেতনে এড়িয়ে যেতে পারেন না। আমাদের গল্প-উপন্যাস, কবিতা-গান, ছড়া, নাটক-প্রবন্ধে কিংবা স্মৃতিচারণায় মুক্তিযুদ্ধ তাই অনিবার্য অনুষঙ্গ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ধুয়া তুলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল হাজার বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি। দেশভাগের পর প্রথম আঘাত আসে ভাষার পর। ১৯৫২ সাল আমাদের বর্ণমালার প্রেমের উজ্জ্বল ভাস্কর্য। আব্দুল লতিফের ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’, বুলবুল খান মাহবুবের ‘একুশ আমার রক্তে বাজায় অস্থিরতার সুর’, কিংবা শামসুর রাহমানের ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ অথবা গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ এ ছাড়াও একুশ নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান ও কবিতা।
এরপর ’৬৬-র ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, শামসুর রাহমানের ‘আসাদের শার্ট’ কিংবা নির্মলেন্দু গুণের ‘আগ্নেয়াস্ত্র’সহ অসংখ্য কবিতা। তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস বিবেচনা করা হয় ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। ২ মার্চ পতাকা দিবস, ৭ মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণ, গোলটেবিল আলোচনা, ২৫ মার্চের কালরাত-অপারেশন সার্চলাইট, ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে করাচি নিয়ে যাওয়া- এসবই বারবার উঠে এসেছে আমাদের গল্প উপন্যাস নাটক কবিতায়। শওকত ওসমানের ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’, ‘নেকড়ে অরণ্য’, ‘দুই সৈনিক’, আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নীল দংশন’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’, সেলিনা হোসেনের ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’, হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’, ‘দেয়াল’, ‘আগুনের পরশমণি’ ইত্যাদি উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের মর্মবেদনার অনেক চিত্র ভাস্বর হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন, মাত্র তিন মাসে আনোয়ার পাশা রচনা করেন ‘রাইফেল রোটি আওরাত’। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে এটিই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস। কিন্তু এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বর্বররা ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরপরাধ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। সেই কালরাতের ভোরের বর্ণনা দিয়েই উপন্যাসটির শুরু। শেষ করেন বিজয়ের প্রত্যাশা নিয়ে। প্রধান চরিত্র সুদীপ্ত শাহিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির জন্য হিন্দুয়ানি নাম তাকে বদলাতে হয়েছে। যুদ্ধের সময় তিনি উপলব্ধি করেন, পাকিস্তানিদের ক্ষোভ শুধু হিন্দু, আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্টদের ওপর না, বাংলা ভাষার ওপরও। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দুই ভাই মালেক ও খালেকের পাকিস্তানপ্রীতি ও রাজাকার মানসিকতার নোংরা চিত্র এ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। পাকিস্তানপন্থি বা রাজাকার হওয়া সত্ত্বেও মালেককে হত্যা করে পাকিস্তানি আর্মি। তার স্ত্রী ও কন্যাদের ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে।
অত্যাচার ও ধর্ষণ শেষে ফেরত পাঠায়। ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয় তিনশ টাকা। তা দেখে মালেকের ভাই উৎফুল্ল, ‘আর্মির জেনারসিটি দেখুন, মেয়েদের ফেরত পাঠাবার সময় চিকিৎসার জন্য তিনশ টাকাও দিয়েছে। দে আর কোয়াইট সেন্সিবল ফেলো।’
রাজনীতির সঙ্গে কবিতার সম্পর্কই বোধকরি সবচেয়ে স্পষ্ট এবং স্বীকৃত। দেশ-কালের যেকোনো সঙ্কটে কবিরা সাহসী ভূমিকা পালন করেন এবং করেছেন। শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, দুঃশাসন, মানবতার স্খলন এবং যাবতীয় প্রতারণা প্রবণতার বিরুদ্ধে কবিরা সর্বদাই সক্রিয়। কবিতার বিজয় কিংবা কবিতায় স্বাধীনতা যেভাবেই বলি না কেন বাংলাদেশের কবিতা আমার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করেছে নিপুণ শক্তিতে, শৈল্পিক উচ্চারণে। মহান মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র মহিমা ও আত্মত্যাগ, বাংলাদেশের কবিদের কলমে অনুভূত হয়েছে আপনবোধ ও সৌন্দর্যে।
কবি শামসুর রাহমান ২৫ মার্চের ভয়াবহতা তুলে ধরেন এভাবে-
‘কখনো নিঝুম পথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে
মনে হয় ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই।’
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ১৮ মিনিটের এক মহাকাব্যিক ভাষণে যিনি সমগ্র জাতিকে একসুতোয় বেঁধে মহাসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। কী ছিল না সেই ভাষণে? প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, নেতৃত্ব, অভাবনীয় শব্দসম্ভার, বাক্য প্রক্ষেপণের শিল্পশৈলী। মূলত এই একটি ভাষণেই আমাদের জন্মপরিচয় নির্ধারণ হয়ে যায়, একটি ভাষণেই রচিত হয় স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। তাইতো কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কী করে আমাদের হলো’ কবিতায় তুলে ধরেছেন ৭ মার্চের সেই মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা-
‘একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্য কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের।
কখন আসবে কবি? কখন আসবে কবি?
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা-
কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতাখানি:
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
নির্মলেন্দু গুণ তার এ কবিতার ভেতর দুটি সংবাদ তুলে ধরেছেন। প্রথম সংবাদ ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান, দ্বিতীয় সংবাদ একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে জ্বলে ওঠা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দ্রোহের আগুন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাহিত্যে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নাটকের তুলনায় কবিতাতেই সবচেয়ে বেশি মর্মস্পর্শী হয়ে প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সেই দুঃস্বপ্নের রাত ২৫ মার্চের কথা লিখেছেন তার ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতায়-
‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে…
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?’
মার্চ আমাদের চেতনায় এক উজ্জ্বল বাতিঘর। ১৯৭১-এর মার্চে সব ভয় ও দ্বিধা জয় করে আমরা বহু থেকে এক হতে পেরেছিলাম। আর আজ স্বার্থের কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে গিয়ে এক থেকে বহু বহু হয়ে যাই।